উত্তরণের আরেক নাম- ঋষি অরবিন্দ | TRANSFORMATION OF AUROBINDO
জন্ম তারিখ ১৫ই আগস্ট, ১৮৭২ সাল। বাবার নাম কৃষ্ণধন ঘোষ। কোনো মনিষীর সংক্ষিপ্ত জীবনী বর্ণনা এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। সেক্ষেত্রে মায়ের নাম উল্লেখ ছিল অপরিহার্য। যে ব্যক্তি প্রসঙ্গে এই আলোচনা, তিনি স্বয়ং ছিলেন আত্মজীবনী বা জীবনী রচনার ঘোরতর বিরোধী। কারণ তিনি মনে করতেন যে, জীবনী বা আত্মজীবনীর ক্ষেত্রে কালানুক্রমিক ঘটনা বর্ণনার আধিক্য সেই রচনাকে প্রায় ইতিহাসে রুপান্তরিত করে। তাহলে প্রবন্ধের শুরুতেই যে দুটি তথ্য পরিবেশিত হয়েছে তার প্রাসঙ্গিকতা কি? প্রকৃতপক্ষে ঐ নির্দিষ্ট দুটি তথ্য আলোচ্য ব্যক্তিত্বের পরিচয় বহনের সাথে সাথে ভবিষ্যতে সাক্ষী হয়ে থাকবে দুটি যুগান্তকারী ঘটনার। ভারতবাসীর কাছে ১৫ই আগস্টের মহিমা ব্যাখ্যা অমূলক। কিন্তু দ্বিতীয় তথ্যের তাৎপর্য! একজন বিদেশিনী, নাম মাদাম মিরা রিচার্ড, কৃষ্ণধন ঘোষের তৃতীয় পুত্র সন্তানের মধ্যে দেখতে পেলেন তার কল্পিত কৃষ্ণ রূপ এবং সেই মূহুর্তে তাঁকে বহু অন্বেষিত গুরু রূপে গ্রহণ করলেন।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই বোঝা গেছে যাঁকে নিয়ে এই আলোচনা তাঁর নাম শ্রী অরবিন্দ ঘোষ। ব্যক্তি এক হলেও, বহু ব্যক্তিসত্ত্বার সমাহার ছিল লক্ষ্যণীয়। সেগুলির মধ্যে দুটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হল বিপ্লবী সত্ত্বা ও যোগী সত্ত্বা। কিন্তু সশস্ত্র বিপ্লব ত্যাগ করে, একই ব্যক্তির যোগীতে উন্নীত হওয়া সম্ভব হল কিভাবে? আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি ঘটনা এই যে অরবিন্দ ঘোষ কারাবাসের (১৯০৮-১৯০৯) আগে পর্যন্ত নিজের মাতৃভাষায় কথা বলা বা লেখার থেকে ইংরেজিতে সেগুলি সম্পন্ন করাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন।
আলিপুর বোমা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে ১৯০৮ সালের ৫ই মে থেকে শুরু হয় শ্রী অরবিন্দ ঘোষের নির্জন কারাবাস। শারীরিক কষ্ট যত, মানসিক কষ্ট ততোধিক। তাঁর কারাবাস সমন্ধে তিনি লিখেছেন কিভাবে তাঁকে নয় ফুট দীর্ঘ এবং পাঁচ-ছয় ফুট প্রশস্ত ঘরে বন্দী জীবন কাটাতে হয়। ঘরে ছিলনা কোনো জানলা। ঘরের সামনে লোহার গরাদ এবং বাইরে একটা ছোট উঠোন। অপরিসীম কষ্টের মধ্যেও বিদ্রুপে বিদ্ধ করেছেন বৃটিশ শাসকদের; কিভাবে একটি বাটি ও একটি থালা দিয়ে যাবতীয় দৈনন্দিন কাজকর্ম সম্পন্ন করতে হত, এমনকি একই বাটিতে কিভাবে মুখ ধোয়া, জল খাওয়া এমনকি জলশৌচও করতে হত তার বর্ণনা হৃদয়বিদারক।
পরাধীন মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার যে ব্রত বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষ নিয়েছেন, কঠিন-প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও তাঁর মন থেকে মুছে যায়নি বিদ্রোহের সেই আগুন।
অনেক অরবিন্দ সমালোচক বলে থাকেন যে নির্জন কারাবাসে, প্রতিকূল পরিবেশে ধ্যান ও উপাসনার আশ্রয়ই একমাত্র পথ, তাই সেক্ষেত্রে তাঁর যোগীতে উত্তরণ কোনো ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। কিন্তু সেই সব সমালোচকদের স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে অরবিন্দ ঘোষ বাঙালি পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও তার পিতা ছিলেন বিলিতি সংস্কৃতির বাহক এবং বালক অরবিন্দ ঘোষের উপরও এই প্রভাব ছিল সুস্পষ্ট। শুধু তাই নয়, তার পিতার ইচ্ছানুসারে পাশ্চাত্য শিক্ষা লাভের জন্য মাত্র সাত বছর বয়সে ভারতবর্ষ ত্যাগ করে ইংলন্ডে চলে যেতে বাধ্য হন তিনি। দীর্ঘ চোদ্দ বছরে পাশ্চাত্য শিক্ষা-সংস্কৃতি- কৃষ্টি-জীবনশৈলী আয়ত্ত্ব করে আবার নিজের দেশে ফিরে আসেন। এই জাতীয় শিক্ষা-সংস্কৃতি প্রাপ্ত মানুষের ক্ষেত্রে এরূপ নির্জন কারাবাস – যা কেবল শারীরিক যন্ত্রণাই নয়, অপরিসীম মানসিক পীড়ায় বিদ্ধ করে- তাকে যে উন্মাদগ্রস্ত করে তুলবে সেটাই স্বাভাবিক। শ্রী অরবিন্দ স্বয়ং বর্ণনাও করেছেন কিভাবে নির্জন কারাবাসের বন্দীদের কেউ কেউ উন্মাদ হয়ে গেছিলেন। তাই অরবিন্দ ঘোষের সাধকে উত্তরণ তাঁর সমালোচকরা যে নির্জন কারাবাসের স্বাভাবিক প্রভাব বলে ব্যাখ্যা করেন তা মোটেই যুক্তিযুক্ত বলে প্রতিপন্ন হয় না। আর তাই যদি হয় তবে অরবিন্দ ঘোষের সাথে সাথে সহ-অভিযুক্তদের মধ্যে থেকেও একাধিক সাধক প্রাপ্তি থেকে ভারতবাসীকে বঞ্চিত হতে হতনা।
বন্দী অবস্থায়, চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে অরবিন্দ ঘোষের জীবনে ঘটে যায় এক পটপরিবর্তন। তিনি উপলব্ধি করেন যে শুধু পাশ্চাত্য শিক্ষাই একজন ব্যক্তিকে সম্পূর্ণতা দিতে পারেনা, তার সাথে প্রয়োজন নিজ দেশের সনাতন ধর্ম ও দর্শন সম্পর্কে প্রজ্ঞা, অনুভব করলেন আত্মদর্শনের। এতটুকু বিলম্ব না করে তাঁর এক আত্মীয়কে দিয়ে কারাগারে আনিয়ে নিলেন গীতা ও উপনিষদ। কিছুদিনের মধ্যেই পাঠ সমাপ্ত হল। শুরু হল আত্মোপলব্ধি ও যোগ সাধনার কঠোর অধ্যবসায়। বাহ্যিক প্রতিকূলতাকে অগ্রাহ্য করে মনকে অন্তর্মুখী করে তোলার প্রচেষ্টা চলল অবিরাম। ধীরে ধীরে পরিবর্তন এল তাঁর চিন্তনে-মননে। শুধু গীতা বা উপনিষদ পড়েই ক্ষান্ত হলেন না, আত্মস্থ করলেন সমস্ত শ্লোক- বিশ্লেষণ করলেন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে। এতদিন সাধারণ মানুষের কাছে যা ছিল ঈশ্বরের বাণী, তাকেই তিনি উপলব্ধি করলেন জীবনদর্শন রূপে। নিজ জীবনেও – মূলত কারাবাসের সময় থেকেই- অনুশীলন শুরু করলেন সেই জীবনদর্শনকে। এই সময়েই তাঁর জীবনে শুরু হল এক নতুন অধ্যায়- অরবিন্দ ঘোষ থেকে শ্রী অরবিন্দ হয়ে ওঠার যাত্রা। আত্মদর্শনের সাথে সাথে দর্শন হয় সর্বশক্তিমানের। আমূল পরিবর্তন ঘটে যায় চিন্তাধারায়। কিন্তু বামপন্থী মতাদর্শ থেকে পুরোপুরি সরে না এসে পুনরায় মনোনিবেশ করেন মাতৃভূমির স্বাধীনতায়। যদিও সুস্পষ্ট পরিবর্তন আসে কর্মপদ্ধতি বিষয়ক পরিকল্পনার। শুধুমাত্র সশস্ত্র বিপ্লবের সাহায্যে স্বাধীনতা তখন আর তাঁর কাম্য পরিস্থিতি থাকেনা, তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে দেশের প্রতিটি মানুষের আত্মোপলব্ধি- আত্মদর্শন এবং মানসিক স্বাধীনতা ব্যতীত সেই দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা সম্পূর্ণতা লাভে সক্ষম হয়না।
শুধুমাত্র আত্মোপলব্ধিই নয়, শুরু হল কঠোর যোগ সাধনা। পথ দেখালেন সম্পূর্ণ এক নতুন যোগসাধনা পদ্ধতির, যা আজ সারা বিশ্বে “Integral Yoga” নামে সমাদৃত। তিনি নিজে সিদ্ধিলাভ করেন অনেক বছর পরে, ১৯২৬ সালে, কিন্তু সিদ্ধিলাভের জন্য যে কঠোর অনুশীলন এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যোগের মাধ্যমে মানবজাতির উত্তরণের পথ আবিষ্কার, তার শুরু আলিপুর জেলের সেই কারাবাস থেকেই। তাই নির্জন কারাবাসের প্রভাবে আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে উত্তরণের স্বাভাবিক তত্ত্বের পরিবর্তে যা পরিলক্ষিত হয় তা হল আধ্যাত্মিক উন্নতির প্রবল ইচ্ছাশক্তি এবং কঠোর অনুশীলন।
জেলবন্দী থাকা অবস্থায় তাঁর কঠোর যোগ অনুশীলন সবার চোখ এড়িয়ে যায়নি। কেউ কেউ লক্ষ্য করেছিলেন তাঁর কঠোর অধ্যবসায়। কিন্তু এই অনুশীলনের ভবিষ্যৎ কি হতে পারে তা বোধহয় সবাই উপলব্ধি করতে পারেননি। কিন্তু যাঁরা সেটা পেরেছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন বিখ্যাত ব্যক্তি হলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। যিনি অরবিন্দ ঘোষের পক্ষে, ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে মামলা লড়লেন। শুধুমাত্র যে মামলা লড়লেন তাই নয়, এমন সব অভাবনীয় এবং অকাট্য যুক্তির উপস্থাপনা করলেন যার ফলস্বরূপ ইতি ঘটল অরবিন্দ ঘোষের অসহনীয় নির্জন কারাবাসের। প্রমাণিত হলনা তাঁর বিরুদ্ধে আনা ব্রিটিশ সরকারের কোনো অভিযোগই, বেকসুর খালাস পেলেন তিনি। অপরদিকে স্বস্তি পেলেন চিত্তরঞ্জন দাশও। কারণ আর কেউ না পারুক, অন্ততপক্ষে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন কার পক্ষে লড়ছেন তিনি। সেই জন্যই তিনি অবিস্মরণীয় উক্তি করলেন শ্রী অরবিন্দ সমন্ধে –
“His words will be echoed and re-echoed, not only in India, but across the distant seas and lands.”